Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গতরাতে কি কোনো স্বপ্ন দেখেছেন? পড়ুন স্বপ্নের সাতকাহন…

গভীর ঘুমের স্বপ্নগুলি অন্যরকম হয়। স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না। বাস্তবের কাছাকাছি চলে যায়। হালকা ঘুমের স্বপ্নগুলি হয় হালকা, অস্পষ্ট কিছু লজিকবিহীন এলোমেলো হয়। গাঢ় ঘুমের স্বপ্ন স্পষ্ট, যুক্তিনির্ভর – হুমায়ুন আহমেদ।

তো, কাল রাতে ঘুমিয়ে আপনি কি কোনো স্বপ্ন দেখেছেন? কী দেখলেন? কতটুকু মনে আছে?

আমাদের জীবনের প্রায় ৩৩% সময়ই কাটে ঘুমন্ত অবস্থায় এবং এর মাঝেও অনেকটা সময় কাটে স্বপ্ন দেখে। মাঝে মাঝে তো স্বপ্ন এত বেশি ভাললাগে যে ঘুম ভেঙে গেলে স্বপ্নটার জন্য মন খারাপ হয়ে যায়, আর কখনো কখনো স্বপ্নে এত ভয় পাই যে ঘুম ভাঙলে মনে হয় “বেঁচেছি!”

‘স্বপ্ন’…প্রচন্ড কৌতূহলোদ্দীপক একটি শব্দ। স্বপ্ন নিয়ে এই প্রচন্ড কৌতূহলই জন্ম দিয়েছে ‘স্বপ্নবিজ্ঞান’ বা ‘oneirology’ এর। স্বপ্নবিজ্ঞানে অন্তর্ভূক্ত আছে স্বপ্ন দেখার প্রক্রিয়া, স্বপ্নব্যাখ্যা, স্বপ্নের প্রভাব এবং স্বপ্নের সাথে সম্পর্কিত অসঙ্গতিগুলোও।

স্বপ্নবিজ্ঞান অনুযায়ী নিদ্রার রয়েছে বেশ কয়েকটি স্তর এবং এর মধ্যে ‘REM’ স্তরে পৌঁছুলেই আমরা মূলত স্বপ্ন দেখে থাকি। ‘REM’ বা Rapid eye movement, অর্থাৎ এ স্তরে অক্ষিগোলক’ খুব দ্রুত নড়াচড়া করে এবং দেহের অন্যান্য অংশ সাময়িকভাবে অবশ হয়ে যায়। ঘুমের ২০% হচ্ছে ‘REM’ স্তর। ১৯৫৩ সালে ‘এসেনরিন্সকি’ এই পর্যায়ের সাথে স্বপ্নের সম্পৃক্ততা আবিষ্কার করেন।

REM স্তরে মস্তিষ্কতরঙ্গের ECG

REM স্তরে মস্তিষ্কতরঙ্গের ECG

‘REM’ স্তরে আমাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এ সক্রিয়তাকে জেগে থাকার সাথেও তুলনা করা যায়। স্বপ্ন হচ্ছে এই অতিসক্রিয়তারই ফসল। স্বপ্নগুলোর একেকটির স্থায়িত্ব কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে হতে পারে ২০-৩০ মিনিট পর্যন্ত। স্বপ্ন দেখার স্তর বা পর্যায় যাকে স্বপ্নবিজ্ঞান বলছে ‘REM’ স্তর, এ স্তরেই যদি মানুষ জেগে থাকে তবে স্বপ্নের কথা তার ভালো মনে থাকবে। এমনিতে অধিকাংশ স্বপ্নই আমরা ভুলে যাই, একরাতে কেউ ৪-৫টি কিংবা ৭টি পর্যন্ত স্বপ্ন দেখলেও সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর তার শুধু একটি বা দু’টির কথাই মনে থাকে।

উদ্ভট ও অধিবাস্তব...এ-ই স্বপ্ন

উদ্ভট ও অধিবাস্তব…এ-ই স্বপ্ন

স্বপ্নগুলো প্রায়ই অধিবাস্তব ও উদ্ভট ধরনের হয়ে থাকে, স্বপ্নে দেখা চরিত্রগুলো কখনো না কখনো স্বপ্নদ্রষ্টার সাথে পরিচিত কিন্তু স্বপ্নে তাদের আচরণ প্রায়ই হবে বাস্তবের থেকে ভিন্ন। স্বপ্নদ্রষ্টা নিজেও তার দেখা স্বপ্নে অংশ নিতে পারে।

স্বপ্ন ভীতিকর হতে পারে…হতে পারে আপনার জন্য রোমাঞ্চকর কোন অভিযানের অনুভূতিও; স্বপ্ন আপনাকে প্রচন্ড বিষাদগ্রস্ত করে তুলতে পারে…যৌন উত্তেজনাও সৃষ্টি হতে পারে স্বপ্ন দেখার মধ্য দিয়ে- প্রচলিত ভাষায় একে বলা হয় ‘স্বপ্নদোষ’। স্বপ্নের সাথে যৌন উত্তেজনা বা অবদমিত যৌনাকাঙ্খার সম্পর্ক নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ফ্রয়েড এ নিয়ে একটি বইও লিখেছেন-‘the interpretation of dreams(1899)’। ফ্রয়েড এর মতে, আমরা ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখি তার অধিকাংশই আমাদের অবদমিত যৌন ইচ্ছার ফল, কিন্তু ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব সর্বজনগৃহীত হয়নি।

ফ্রয়েডের সমসাময়িক আরেক মনোবিজ্ঞানী ও গবেষক কার্ল জাং, ফ্রয়েডের তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। জাং এর মতে স্বপ্ন যতটা না গোপনভাব দেখায় তার চেয়েও অনেক বেশি প্রকাশ করে- “dreams reveal more than they conceal”। স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করেছেন যারা, তাদের মধ্যে ‘ক্যালভিন এস হল’ একটি জনপ্রিয় নাম। ১৯৪০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই গবেষক পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি স্বপ্নসম্বন্ধীয় প্রতিবেদন সংগ্রহ করে একটি গবেষণা করেন যা থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়- সমগ্র বিশ্বের মানুষ প্রায় একই ধরনের বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখে এবং অধিকাংশ স্বপ্নের বিষয়ই গতদিন বা গত সপ্তাহের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। ক্যালভিন হলের তথ্য বিশ্লেষণে এও দেখা যায় যে, যৌবনে মানুষের মোট স্বপ্নের ১০% এর বেশি যৌন বিষয়ে হয়না।

স্বপ্ন ঘুম ভাঙার পর মন ও শরীরে বেশ ভালই প্রভাব ফেলে। স্বপ্নের মধ্যে সৃজনশীল চিন্তার উৎপত্তিও ঘটে এবং স্বপ্নদ্রষ্টা উৎসাহিতও অনুভব করেন।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম স্বপ্ন নিয়ে বেশ কয়েকটি মজার ঘটনাও আছে…

রসায়নের মূল ভিত্তি পর্যায় সারণীর উদ্ভাবন ঘটেছিলো স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিফ একদিন পর্যায় সারণী নিয়ে গবেষণা করতে করতে ডেস্কেই ঘুমিয়ে যান এবং স্বপ্নে দেখতে পান মৌলগুলোর বিন্যাস কৌশল। ঘুম ভাঙ্গার পর তিনি একটি কাগজে তা লিখে ফেলেন এবং পরবর্তী সময়ে এর সংশোধিত রূপই হচ্ছে আজকের পর্যায় সারণী। এ নিয়ে মেন্ডেলিফ বলেছিলেন,

স্বপ্নে আমি দেখলাম একটা ছকে সবগুলো উপাদান জায়গামতো বসে যাচ্ছে এবং ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই আমি একটি কাগজে তা লিখে ফেলি।

শুধু এই নয়, জৈব রসায়নের বেনজিন চক্রও এসেছিলো এমনই একটি স্বপ্নের পথ ধরে! বেনজিন চক্রের বিন্যাস নিয়ে বিজ্ঞানীরা যখন ভীষণ চিন্তিত, ১৮৬৫ সালে বিজ্ঞানী অগাস্ট কালকুলেল গবেষণার এক পর্যায়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং স্বপ্নে দেখতে পান একটি লম্বা সাপ চক্রাকারে ঘুরছে ও নিজের লেজ খেয়ে ফেলছে…সাপটির দেহে তিনি দেখতে পান কার্বন ও হাইড্রোজেনের সঠিক অনুপাত ও ঘুম ভাঙ্গার পর এই চাক্রিক সাপের এই রূপ থেকেই বের করে ফেলেন বেনজিন চক্র!

স্বপ্নে হতে পারে ইচ্ছেপূরণ, যা বাস্তবে পাননি।।

স্বপ্নে হতে পারে ইচ্ছেপূরণ, যা বাস্তবে পাননি।।

রামানুজন আচার্যের কথা কে না শুনেছে…? একটু অদ্ভুত ধরণের গণিতবিদ ছিলেন এই রামানুজন, তিনি নাকি স্বপ্নে গণিতের নতুন নতুন সূত্র পেয়ে যেতেন! রামানুজন তার স্বপ্নপ্রাপ্ত সূত্র নিয়ে প্রায়ই বলতেন,

ঘুমানোর সময় আমার অদ্ভূত এক অভিজ্ঞতা হয়। আমি দেখছিলাম রক্তে বয়ে যাওয়া লাল একটি পর্দা, যাতে হঠাৎ করেই একটি হাত এসে লেখতে শুরু করলো। হাতটি উপবৃত্ত সম্পর্কিত কিছু যোগজও লিখলো। জেগে উঠার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি তা কাগজে লিখে ফেললাম।

এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়, মানুষ যখন কোনো একটি বিষয় নিয়ে খুব বেশি ভাবতে থাকতে তার সে ভাবনার ক্ষরিত রূপ মস্তিষ্কে থেকে যায় এবং স্বপ্নে এর প্রকাশ ঘটে অথবা বলা যায় ঘুমালেও ভাবনার প্রক্রিয়াটি চলমান থাকে।

সংস্কৃতিভেদে, সময়ভেদে স্বপ্নের অর্থ বা স্বপ্নব্যাখ্যা আমাদের কাছে বিভিন্নরূপে বিভিন্নবার এসেছে। প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা ভাবতো, স্বপ্ন হচ্ছে মৃত ব্যক্তি থেকে সরাসরিভাবে প্রাপ্ত কোন বার্তা যা কিনা ভবিষ্যদ্বাণীও হতে পারে…! চীনদেশের ইতিহাসেও স্বপ্ন নিয়ে বেশ কিছু তথ্য মেলে। চীনারা ভাবতো ঘুমালে আত্মা দেহকে ছেড়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে এবং এই ভ্রমণের দৃশ্যগুলোকেই বলি স্বপ্ন। সে সময়কার চৈনিক দার্শনিক ‘ওয়াং চোং’ এই মতবাদকে মেনে নেননি।

ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ ‘উপনিষদ’ এ স্বপ্নের দু’টো দিকের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। একদিকে স্বপ্নকে সুপ্তাকাঙ্খার প্রকাশ বলে ব্যক্ত করা হয় এবং অন্যদিকে মানা হয় যে, ঘুমন্ত অবস্থায় আত্মা দেহকে পাহারা দেয় এবং এ থেকেই স্বপ্নদর্শন ঘটে। গ্রীক দার্শনিক হিপোক্রেটিস স্বপ্নের খুব সহজ-সরল একটি তত্ত্ব দেন- “দিনের বেলা আত্মা বার্তা গ্রহণ করে ও রাতে তা থেকে দৃশ্য উৎপন্ন করে”। আরেক গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন, স্বপ্ন শারীরিক সমস্যা বা রোগ-বালাই এর পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।

'এলিস ইন ওন্ডারল্যান্ড' সিনেমার দৃশ্য (লুইস ক্যারলের গ্রন্থ অবলম্বনে)

‘এলিস ইন ওন্ডারল্যান্ড’ সিনেমার দৃশ্য (লুইস ক্যারলের গ্রন্থ অবলম্বনে)

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীকদের মধ্যে প্রথম স্বপ্নভিত্তিক বই রচনা করেন ‘এন্টিফোন’। আমাদের দেশে ‘খোয়াবনামা’ বইটি তো স্বপ্নের অর্থ খুঁজবার জন্য বহুল পরিচিত একটি বই। স্বপ্ন যেমন স্বপ্নময় একটি বিষয়, স্বপ্ন নিয়ে লুইস ক্যারোলের ‘এলিস ইন ওন্ডারল্যান্ড’ ও তার সিক্যুয়েলগুলোও স্বপ্ন নিয়ে বেশ ভালো কল্পকাহিনী হিসেবে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

স্বপ্ন মানুষের এমন একটি মানসিক অবস্থা, যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষ বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনা অবচেতনভাবে অনুভব করে থাকে। ঘটনাগুলো যদিওবা কাল্পনিক, দেখার সময় কিন্তু ওগুলোই সবচেয়ে বেশি সত্য বলে মনে হয়! তাই সুন্দর হোক রাতের স্বপ্নগুলো…

বহুমাত্রিক স্বপ্ন থাকুক প্রতিরাতে!

বহুমাত্রিক স্বপ্ন থাকুক প্রতিরাতে!

This article is in Bangla language. It's about deduction of dream.

Featured Image: quotespics.net

 

Related Articles